কবিতার নাম : “প্রিয় নেতাজী”
প্রিয় নেতাজী, অনেকদিন ধরেই তোমাকে চিঠি লিখবো ভাবছিলাম। কিছুতেই আর হয়ে উঠছিল না। আজ কোনো একটা ঘটনার নিরিখে তোমাকে চিঠি লিখতে বসলাম। ছেলেবেলায় আমাদের দোতলার ড্রয়িংরুমে তোমার ছবি, জন্মদিনে পেতাম বই সেখানেও তুমি। বাবার গল্পে তোমারি বীরত্ব।দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে ক্রমে আমিও তোমার ভক্ত। বাবা বলতেন ইন্ডিয়ার আর একজন নেতাজির দরকার ছিল।
মা গাইতেন “বীর সুভাষের মহান দেশ”, দাদু বলতেন “ছেলেটাকে ওরা শেষ করে দিল”। ঠাম্মার চোখে তখন আঁচলের খুঁট। এসবের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা আমিও কেমন একটা ঘোরের মধ্যে থাকতাম। ভাবতাম, পারতে তুমি সব পারতে, যদি আর একবার, একবার আমাদের মধ্যে তোমাকে পেতাম। আজ উত্তর চল্লিশে আমার একি ঘোর। তুমিই পারতে কেননা দেশের মাটিতে দেশপ্রেমের মত জোরালো একটা ঝাঁকুনি দেবার ক্ষমতা তখন আর কারো ছিল না। এখনো আছে কী? তোমার হারিয়ে যাবার পর দেশে কত কমিশন বসেছে, ভারতের পূর্ব – পশ্চিম, উত্তর – দক্ষিণ। কোনও পীর, কোনও সন্ত কোনও দয়ালু বৃদ্ধকে দেখে ভুল করেছে সবাই। ছুটে গেছে তুমি মনে করে, কিন্তু ফিরেছে মাথা নেড়ে। তবুও তোমাকে পাবার আশায় বুক বেঁধেছে। তুমি তো শুধু বসে পরিবারের নও। গোটা ভারতবর্ষের মনিকোঠার হীরক, যার আলোর শুদ্ধতা কালোকে সাদা করতে পারে – এই বিশ্বাসে ভর করে সবাই ভেবেছিল তুমি আসবে, আসবেই; কিন্তু এলেনা। কেটে গেলো অনেকগুলো বছর। পেরিয়ে এলাম জীবনের অনেক গোলি খুঁজি। তুমি এখন বিমানবন্দরে, সভা-সমিতিতে, রিসার্চ বিউরোতে, এমন কি ছেলের নামকরণেও। শুধু হৃদয়ে যেন দোলা দেয় না। জানো? তোমার জন্মদিন টা এখন সবাই ‘ছুটির দিন’ ব’লে আয়েস করে উপভোগ করে। আর ছেলেরা? তারা তো এখন দেশ থেকে বিদেশের খবরই বেশি রাখে। আর মেয়েরা? তারাও স্বাধীনতার ভেলায় চড়ে হতচকিত। শুধু মাটি কাঁদে। সেই কান্না যেন ভূমিকম্প – ক্ষরা – এলনিনো – বন্যা হয়ে চারিদিক ভাসিয়ে দেয়। এখনো অভিমান করে শুয়ে থাকবে রেনকোজিতে? আজ যখন ঘাড়ের উপর এ কে ফরটিসেভেন – এর নিঃশ্বাস, রক্তের হোরিখেলা ধর্মের জিগিরে, তখন শোনাও তোমার সেই আওয়াজ,” আমি সুভাষ বলছি”। মেয়েটা দৌড়ে এসে বলবে “মা, মা দেখো উনি আসছেন”।
পাশের বাড়ির মেসোমশাই ডাকবেন জানলা দিয়ে,” বৌমা আমি বলিনি উনি ফিরে আসবেন?”
খোলা জানালার ধারে দাঁড়াবেন মেয়েরা, তাদের ডান হাতে শঙ্খ, বাঁ চোখে জল, নদী হবে উত্তাল, নৌকা বেসামাল। পরান মাঝিও চেঁচাবে,” উনি আসছেন”।
সবুজ মাঠে শিশুদের হাতে পতাকার দোলা, উনি আসছেন, উনি আসছেন, উনি ফিরে আসছেন।
তোমার হারিয়ে যাওয়া জন্মদিনের ভেতর থেকে উঠে আসুক আর একটা তেইশে।
আজ স্বাধীনতার ঠিক আগের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তোমাকে আমার এই চিঠি।
প্রণাম নিও, ভালো থেকো নেতাজি, প্রণাম নিও।।
।।সমাপ্ত।।