কবিতা ‘শহীদ’, কবি শুভ দাশগুপ্ত। কবি শুভ দাশগুপ্তর কবিতা ‘শহীদ’।

কবিতা ‘শহীদ’, কবি শুভ দাশগুপ্ত

ব্যানার্জি পাড়ায় আজ লোকে লোকারণ্য। বন্ধ সব বাজার দোকান ইস্কুল, অফিস। গোটা এলাকা টা শুধু মানুষের ভিড়ে গুঞ্জনে অচেনা এক চেহারায় থমকে আছে। ভিড় হয়েছে খুব, কিন্তু কোলাহল হইচই নেই। সকলেই কথা বলছেন, নিচু স্বরে, গলা নামিয়ে। দু:সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। সেরকমই অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ছড়িয়ে পড়েছে খবর। এ পাডার একুশ নম্বর বাড়ির অপূর্ব, ক্যাপ্টেন অপূর্ব রায়চৌধূরী শহীদ হয়েছেন সীমান্তের যুদ্ধে। ঝলমলে, হাসিখুশি অপূর্ব এমনিতেই পাড়ার সবার প্রিয়, তার ওপর রেডিও-টিভিতে যখন তার বীরত্ব, আত্মবলিদানের কথা বারবার প্রচারিত হয়েছে, এপাড়ার মানুষের চোখ ভরে উঠেছে জলে, আর বুক ভরেছে গর্বে, অহংকারে। হ্যাঁ ক্যাপ্টেন অপূর্ব আজ সারা দেশের গর্ব। শত্রুর মোকাবেলা করতে গিয়ে সে ভয় পায়নি, পালিয়ে যায়নি, লড়েছে বীরের মতো। তাই বীর অপূর্বর এমন মৃত্যু টেনে এনেছে হাজারো মানুষকে – বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন – প্রতিবেশী। ভীড় আজ ব্যানার্জি পারাকে পাগল করে দিয়েছে। সকলেরই এক প্রতীক্ষা কখন আসবে অপূর্ব । অপূর্ব নেই আসছে অপূর্বর মৃতদেহ। পাড়ার ছেলেরা ইতিমধ্যেই বড় রাস্তার মোড়ে সাজিয়েছে ফুলে ঢাকা তূরণ, যার উপর জ্বলজ্বল করছে লেখা ‘শহীদ অপূর্ব রায় চৌধুরী অমর রহে’। বাড়ির উঠোনে পাঁচিলে রকে রাস্তায় সর্বত্র অগুন্তি মানুষ, শুধু মানুষ। সকলেই একবার দেখতে চাই এই মহান শহীদকে। জয়ধ্বনি উঠছে অপূর্বর নামে।




সব কোলাহল সব উৎকণ্ঠার বাইরে একুশ নম্বর বাড়ির দোতলার ছোট্ট ঘরটায় পাথরের মতো স্তব্ধ বসে আছেন মনোরমা। অপূর্ব তার একমাত্র সন্তান। চোখের জল শুকিয়ে গেছে, বুকে পাথর চাপা যন্ত্রণা। মনোরমা একা বসে আছেন খাটে। দেওয়ালে ঝুলছে অপূর্বর বাবার ফটো। চন্দনে সাজানো কপাল। অপূর্বর বাবাও যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন। আজ মনোরমার স্মৃতিতে বারবার দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে সেই দিনটার কথা। সেদিনও প্রতীক্ষারত এমনই হাজার মানুষের ভিড়। সেদিনও এমনি জয়ধ্বনি। মনোরমার মনে পড়ছে নিজের বিয়ের কথা। অপুর জন্মানোর কথা। অপুর ইস্কুলের দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে সপরিবার হরিদ্বারে বেড়াতে যাবার কথা। অপু তখন কত ছোটো, কোলে করে করে বেড়ানো। সেই সুন্দর সকাল-সন্ধ্যের কথা ঘুরেফিরে মনে আসছে মনোরমার। সামনের অঘ্রানে ছেলের বিয়ে ঠিক করেছিলেন। মধ্যমগ্রামের সুচরিতা অপূর্ব বন্ধুই ছিল। ওদের দুটিকে মানাত দারুন! আজ মধ্যমগ্রামের বসন্তকুটিরেও চোখের জল। বুকভাঙা যন্ত্রণার স্তব্ধতা। চঞ্চল হয়ে উঠল জনতার ভিড়, জলপাই রঙের সুবিশাল ট্রাক ডুকছে ব্যানার্জিপাড়ায়। মিলিটারি ট্রাক ফুলে ফুলে সাজানো। ফুলে ঢাকা কফিনে চড়ে ঘরে ফিরছে এ পাড়ার অপূর্ব। কান্নার রোল উঠল, উঠল জিন্দাবাদ ধ্বনি। বাতাস ভরে উঠলো হা হুতাশে। আকাশ উন্মত্ত হয়ে উঠল স্লোগানে। ভিড়ের চাপে শৃঙ্খলা ভেঙে গেল। সকলেই একবার দেখতে চাই ক্যাপ্টেন অপূর্ব রায়চৌধুরীকে। ফটোগ্রাফার সাংবাদিকরা চঞ্চল ব্যস্ত, ব্যস্ত টিভির ক্যামেরা। হইচই, কান্না, হাহুতাশ সবমিলিয়ে ব্যানার্জিপাড়া বিধ্বস্ত, বিভ্রান্ত, অস্থির। মনোরোমা উঠে দাঁড়ালেন, শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন নিজের পায়ে। তারপর ধীর পায়ে হেটে সিঁড়ি বেয়ে নামলেন উঠোনের কোলাহলমুখর, শোকবিহ্বল অসংখ্য মানুষের ভিড়ে। কেউ কেউ এগিয়ে এলো মনোরমাকে সান্তনার স্পর্শ দিতে। কেউ এগিয়ে এলো শকস্তব্ধ এই জননীকে একটু ভরসা জোগাতে। মনোরমা কোন দিকে তাকালেন না। গম্ভীর থমথমে মুখ। সমবেত মানুষের ভিড়ে হঠাৎ স্তব্ধতা নেমে এলো। কারো মুখে কোন কথা নেই। চুপচাপ গোটা এলাকাটা। ফুলে ফুলে ঢাকা অপূর্ব শুয়ে আছে শেষ শয্যায়। সেনাবাহিনীর লোকজনেরাও নিশ্চল, পাথর। এতক্ষণ যে অপূর্বর নামে নানা জয়ধ্বনির কলরোল উঠছিল সব থেমে গেছে। নেমেছে দমবন্ধ করা এক আশ্চর্য নিস্তব্ধতা। ভিড়ের দিকে তাকিয়ে মনোরমা আরো শক্ত হলেন। তারপর দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,” অপূর্ব এবাড়ির দ্বিতীয় শহীদ। ওর বাবাও যুদ্ধেই মারা গিয়েছিলেন। একটা জীবনে দু – দুটো এত বড় বিপর্যয় আমাকে সহ্য করতে হলো। আপনারা অপূর্বর জন্য গর্ব করছেন, জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, গর্ব আমারও হচ্ছে। যেদিন ওর বাবার মৃতদেহ এইরকম কফিনে করে এসেছিল এ বাড়ির উঠোনে, সেদিনকার ভিড় থেকেও জয়ধ্বনি উঠেছিল ভারতবর্ষের সেই শহীদের জন্য। সেদিনও বুকে পাথর চাপা দিয়ে সহ্য করেছি সব কোলাহল। আজ অন্য কিছু বলতে চাই, অন্য কথা। অপুর মৃত্যুর বিশদ বিবরণ আমার হাতে এসেছে। মিলিটারি বাড়ির বউ এবং মা আমি। যুদ্ধের কথা, আগুনের কথা, ধ্বংসের কথা, মৃত্যুর কথা সারাজীবন শুনেছি, সহ্য করেছি। আজ অন্য কিছু বলতে চাই, অন্য কথা। মারা যাবার আগে সম্মুখ সমরে অপুর মেশিনগানের গুলিতে মারা গিয়েছে অন্তত সাতজন শত্রুসৈন্য। একথা গর্ব করে লিখে জানিয়েছেন মেজর সাইগল তাঁর চিঠিতে। দু-দুবার স্বজনহারানো ভয়ঙ্কর কালবেলার সামনে দাঁড়িয়ে আমি এক মা, এক গৃহিণী প্রশ্ন করছি ‘অপুর গুলিতে যারা মারা গেল সেই সাতজনের মা কি করছে এখন?’ সেই সাতজনের বাড়িতে-পাড়ায়-মহল্লায় কি উঠছে না জয়ধ্বনি? সেই সাত জননীর বুক কি ভেসে যাচ্ছে না বুকভাঙা কান্নায়? কতকাল আর চলবে এসব? কতকাল? দু’দেশের নেতাকর্তারা কেউ যুদ্ধ করেন না। তাদের কারো জন্য তাদের পরিবারে নেমে আসে না এমন ভয়ঙ্কর দুর্যোগ। তাদের কারো পত্নীর সিঁথির সিঁদুর মুছে যায় না। কারো মা বুকফাটা আর্তনাদে আকাশ ভারি করেন না। দু’দেশেই কিন্তু আমার অপুরা মরে, মরছে, মরে চলেছে। পঞ্চাশ বছর ধরে চলেছে এ মৃত্যুমিছিল। ক্ষমতার মসনদে বসা দেশ-দরদী রাজা মন্ত্রীরা পঞ্চাশ বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন এই মৃত্যুর নারকীয় খেলা। দু দেশই। মা-ই বোঝে সন্তান হারানোর বেদনা কত গভীর! স্ত্রীই জানে সিঁথি শূন্য হওয়ার অভিশপ্ত লগ্ন কি ভয়ংকর! মায়ের জাত নেই দেশ নেই। স্ত্রী বা পত্নীরও জাত এই দেশ নেই, আছে ভালোবাসা, বুক ভরা ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা পঞ্চাশ বছরের ক্রমাগত রক্তক্ষরণে ক্লান্ত। রক্তঝরা হৃদয়ে তাই বলছি “কত কাল, আর কত কাল ভালোবাসা এমন করে বারবার রক্ত ঝরিয়ে মুখ লুকোবে সাদা ফুলে ঢাকা কফিনে? কত কাল? আর কত কাল?”

Share with your friends

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *