কবিতা : রচনার রবীন্দ্রনাথ, কবি – সুনেত্রা ঘটক

রচনার রবীন্দ্রনাথ

কবি: সুনেত্রা ঘটক

সাবানের ঠান্ডা গন্ধ, অবিরাম জল পড়ার শব্দ। আর স্নান করতে করতে আমার মায়ের খোলা গলায় নিজের মনে গেয়ে যাওয়া রবীন্দ্র সংগীত। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ মানে এইসব। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ মানে পঁচিশে বৈশাখের আনন্দ উৎসব নয়, বাইশে শ্রাবণের ব্যথা নয়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি কিংবা বোলপুরের বিশ্বভারতী, আমি কোথাও তাকে তেমন করে পাই না, যেমন পাই আমার মায়ের খোলা গলার গানে।তবে তাও যেমন-তেমন কিংবা যখন তখন নয়। সন্ধ্যের অন্ধকার ঘনিয়ে আসা শেষ বিকেলে মা যখন অফিস থেকে ফিরে স্নানঘরে শুদ্ধ হতে যায়, তখন। আমার মা কখনো গান শিখে নি। কেন শিখেনি ! এমন গলা। মা বলেন রবি ঠাকুরের গান তো তানের নয়, প্রাণের। আসলে তার মুখেই এমন কথা মানায়। কারণ, বাড়ির পরিবেশ থেকে পাওয়া শিক্ষায় মাকে তৈরি করে দিয়েছিল। আর শেখার দরকার কি? একথা বলেন আমার বাবা। মা যখন কলঘরে তার প্রাণের গান গাইতে থাকে, তখন জলের ঝির ঝিরে শব্দগুলো যেন সহস্র বীণা হয়ে গানের কথাগুলোকে সুরের সঙ্গে একাকার করে দিয়ে আমার শরীরে ঢুকে যায়। আমি বুঝতে পারি, এখন আমার আর রক্ষা নেই। আমি এখন আর কিছুই করতে পারবোনা, শুধুই শুনে যাওয়া ছাড়া। তাই মা স্নান ঘরের দরজা বন্ধ করলেই, আমি বাইরে কান পাতি। আমি কিন্তু সব শব্দের অর্থ বুঝি না, সেদিন মা গাইছিল “যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইবো কত আর, আর পারিনে রাত জাগতে হে নাথ ভাবতে অনিবার”।

“অনিবার”, ‘অনিবার’ শব্দের অর্থে এসে আমি হোঁচট খেয়েছিলাম। আর মাও বোধহয় সব কথাগুলো জানা না থাকায় ঘুরেফিরে ওই দুই লাইনই গাইছিল। ফলে অর্থ বুঝতে না পারার যন্ত্রণায় আমি ছটফট করছিলাম। মাকে জিজ্ঞাসা করতেই মা বলল,”এবার তোমার ক্লাস সিক্স হলো সব কথার অর্থ জানতে চইবে না, নিজে আবিষ্কার করার চেষ্টা করো। ভাবো, আরও ভাবো।” আমি ভাবতেই থাকি, ভাবতেই থাকি, কূলকিনারা পাই না। মা বলে, “তুমি সত্যিই ভাবছো? একটুও না থেমে।” আমি বলি, “সত্যি ভাবছি মা ননস্টপ। মা বলল, “ননস্টপ ভাবতে পারছ, আর ভাবতে ‘অনিবার’ এত কঠিন হলো বোঝার পক্ষে?” ইস্কুলে আমরা অনেক উঁচু ক্লাসে এসে বাংলা পড়তে শুরু করি, তাই সত্য কথায় এসে বারবার মুখ থুবড়ে পড়তে হয়। কিন্তু আমার মায়ের গান আর রবীন্দ্রনাথ – এই দুইয়ে মিলে আমার স্টকে এখন অনেক বাংলা শব্দ। সেই অর্থে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু আমার মাস্টারমশাই, এমনকি আমার ডিকশেনারীও। কিন্তু শুধুই তাই নয়। রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে আরও অনেক কিছু। আমার মায়ের একটা প্রিয় গান “কাঁদালে তুমি মোরে, ভালোবাসারই ঘায়ে’। দু একদিন পরে পরেই মায়ের মুখে গানটা শুনতে শুনতে এ গানটা আমার এমন আপনার হয়ে গেছে যে এর যে আলাদা কোন মানে থাকতে পারে তাই আমার মাথায় আসে নি কখনো। মার কাছে জানতেও চাইনি। কিন্তু সেদিন, হঠাৎ যেদিন বিকেল হতে না হতেই অন্ধকার ঘনিয়ে এলো, আমাদের এক রত্তি বাগানের কচি কচি গাছগুলো ভেজা বাতাসে উতাল পাতাল হতে থাকলো, আমার হঠাৎই মনে এলো “নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে” এই কলিটি। হঠাৎ মনে হলো প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাসে গাছগুলো তো এখনই ছেড়ে ছুটে যাবে, তবু যেন ওরা দারুন আনন্দে আছে। সেই প্রথম বুঝলাম কান্নার সঙ্গে ভালবাসার একটা নিকট সম্বন্ধ আছে। গভীর দুঃখের সঙ্গে আনন্দের। গাছেদের ভালোলাগা, চারপাশে প্রাকৃতিক উল্লাস, আর আমার বুঝতে পারার ভালোলাগায় আমি কতক্ষণ বুঁদ হয়ে জানলাধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানিনা। চমক ফিরল যখন বুঝতে পারলাম আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, ভীষণ, ভীষণ। কি একটা ব্যথা আমার গলার কাছটা চেপে ধরেছে! এরইমধ্যে ঝমাঝম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আমার কষ্ট, আমার ভালো লাগা সবকিছুকে ছাপিয়ে বৃষ্টির ধারা আমার সারা শরীর ঝাপটাই ভিজিয়ে দিল। জলের ঝাঁট থেকে ঘর-দুয়োর বাঁচাতে মা যে কখন জানলা বন্ধ করতে শুরু করেছে টের পাইনি। টের পেতেই জানতে চাইলাম,” অভিসার মানে কি মা?” মা বলল,” অভিসার আবার কোথায় পেলে?” ” কেন? তোমার গানে?” ” আমার গানে অভিসার? ও হো হো তোমারও অভিসারে যাব অগম পারে।” ” হ্যাঁ ওখান থেকে।” ” অভিসার মানে, অভিসার মানে যাওয়া, কিন্তু যাওয়া ততটা নয়, যতটা যেতে চাওয়া।” বলেই মা তার ঘর-গেরস্থালি গুছাতে কোথায় যে উধাও হলো! ‘গমন’ মানে যদি ‘যাওয়া’ হয়, তাহলে ‘অগম’ মানে যেখানে যাওয়া যায় না। ‘অগম’ শব্দটার মানে বুঝতেই অভিসারে যেতে চাওয়া, যেতে পারা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝলাম কেন পরানে বাজে বাঁশি আর কেনইবা নয়নে বহে ধারা। বুঝলাম দুঃখের মাধুরী মানে ভালোলাগা দুঃখ। আরও বুঝলাম সব কেড়ে নিয়ে কেউ কিছুতেই ছাড়েনা। আবার যার কেড়ে নেয়া হলো তার মন সরেনা যেতে। দরজায় ছিটকিনি খুলে বাগানে নামতেই গাছেদের মতো অবস্থা হলো আমার। সকলি নিবে কেড়ে দিবে না তবু ছেড়ে।

মন সরে না যেতে ফেলিলে একি দায়ে? ভিজতে ভিজতেই বুঝতে পারলাম একথার আসল মানে টুকু। ঝর্ ঝর্ বৃষ্টির অবিরাম ধারায় ভিজতে ভিজতে আমার মায়ের মতোই খোলা গলায় গাইতে লাগলাম “তোমারো অভিসারে যাব অগম-পারে। চলিতে পথে পথে বাজুক ব্যথা পায়ে কাঁদালে তুমি মোরে। ভালোবাসা” জানলায় চোখ পড়তেই দেখি আমার মতো করে মা আমার গান শুনছে। চোখাচোখি হতেই বলল,” ঢের হয়েছে, উঠে এসো এবার।” সপ সপে ভেজা জামায় ঘরে ঢুকেই দেখি বাবা ফিরে এসেছেন কখন। বললেন,”বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বর্ষার গান এলো না মনে?” বাবাকে কি করে বোঝাই ‘অভিসার’ শব্দের মানে টুকু এখন আমি জানি। আজই জেনেছি, জেনেছি ভালোবাসার আঘাতে কেমন করে কাঁদা যায়। এইসব নিয়েই আমার রবীন্দ্রনাথ। আমার রবীন্দ্রনাথকে আমি এভাবেই মেঘলা আকাশে, বাদল- বাতাসে, মায়ের স্নানের শব্দে, সাবানের গন্ধে, বিকেলের মরে যাওয়া আলো-অন্ধকারে বারবার পেতে চাই। বছরের পর বছর, প্রতি বছর যত দিন যাবে।
সমাপ্ত।।

Share with your friends

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *